যে খুশি গুলো এখনও হারায়নি
-শম্পা দেবনাথ
দড়িটা আঙ্গুলে পেঁচিয়ে চলেছে অন্তরা।খুব মন দিয়ে একবার বাঁ হাতে ,একবার ডানহাতে।মৃনাল চা নিয়ে বারান্দায় আসতেই দড়িটা লুকিয়ে ফেলে অন্তরা।মৃনালের চোখ এড়ায় না সেটা।
“নাও,অনু চা খেয়ে নাও। আমি পুষ্প এলেই বাজারে যাব।তুমি ততক্ষণে চা খেয়ে স্নান সেরে নাও।” চায়ের কাপটা অন্তরার হাতে তুলে দেয় মৃনাল।নিজেও কাপ নিয়ে সামনের বেতের চেয়ারটায় বসে।
পুষ্প না এলে অন্তরাকে একা রেখে বেরোনো যায় না।কখন কি করে ফেলে।আজ অন্তরা বেশি চুপ হয়ে আছে।মানসিক ব্যাধিটা বেড়েছে মনে হয়।ডাক্তারকে ফোন করতে হবে।অন্তরাকে দেখতে দেখতে ভাবে মৃনাল।এই দু বছরে কতটা বুড়িয়ে গেছে।পয়তাল্লিশের অন্তরাকে দেখলে পঞ্চান্ন মনে হয়।চুলগুলো রূপোলি রেখায় ভরে গেছে।মুখের চামড়ায় কাটাকুটি।তাতানের চলে যাওয়া ওকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে মনে ও শরীরে। অবশ্য করবে নাই বা কেন?বাইশ বছরের জলজ্যান্ত একমাত্র ছেলে যদি এভাবে চলে যায়, যেকোন মায়ের পক্ষেই তা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
তাতান ওরফে ঋষভ রায় ক্রিকেটার হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করেছিল সবে।ক্রিকেটই ছিল একমাত্র ধ্যান জ্ঞান।পড়াশোনায় মাঝারি তাতান ছোট থেকেই ছটফটে, প্রাঞ্জল, হাসিখুশি।যেখানে থাকত মাতিয়ে রাখত।ঘন কালো কোকড়ানো চুলের, উজ্জ্বল ,মায়াবী চোখদুটোতে পৃথিবী জয়ের স্বপ্ন মেখে থাকত।অন্তরা,মৃনাল কোনদিনই ওর কোনও ইচ্ছের বিরোধিতা করে নি।কলেজের প্রথম বর্ষে তাতান যখন ঘোষনা করল যে ,সে ক্রিকেটটাই মন দিয়ে খেলতে চায়, তখন অন্তরা একটু মৃদু আপত্তি করেছিল শুধু।অন্ততঃ পড়াটা শেষ করুক এটা চেয়েছিল অন্তরা।মৃনাল কিন্তু ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল।ছেলের দীপ্ত ,প্রতিজ্ঞাবদ্ধ চোখের দিকে মনের অদম্য ইচ্ছেটাকে উৎসাহ দিয়ে বলেছিল, “সাথে আছি, তুই এটাই কর।অন্য কিছু ভাবতে হবে না”।ধীরে ধীরে তাতানের স্বপ্ন সফল হতে শুরু করেছিল।রঞ্জিতে যেদিন সিলেক্ট হয়েছিল তাতান ,সেদিন রায় বাড়িতে উৎসবের আমেজ।পাড়ার সবাইকে মিস্টি খাইয়েছিল মৃনাল।
নিয়তি বোধহয় অলক্ষ্যে হেসেছিল।এত সুখ সহ্য হল না কারোই।রঞ্জিতে খেলতে যাওয়ার পাঁচদিন আগে কিছু বন্ধুদের সাথে আ্যকোয়াটিকা যাবার পথে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ডিভাইডারে ধাক্কা মারে।সবাই কম বেশি চোট পায়।তাতান দরজা খুলে ছিটকে ল্যাম্পপোস্টের ওপর আছড়ে পড়ে।বা পা টুকরো টুকরো হয়ে যায়।একমাস হাসপাতালে থেকে ক্ল্যাচ নিয়ে যখন ঘরে ফেরে তখন আগের সেই তাতান আর নেই।রোগা,কালশিটে পড়া চোখে আলো নেই।অন্তরা ছেলে বেচেঁ ফিরেছে তাতেই খুশি।তাতানকে সবাই খুব উৎসাহ দিতে থাকে।কিছুদিন পর সমস্যা শুরু হয় আবার।তাতানের ওই পা আবার ফুলতে শুরু করে।আবার ডাক্তার, অন্য হাসপাতাল।মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে যখন ডাক্তাররা বলে দেন,তাতানের পা মারাত্মক ভাবে জখম হয়েছে।সারাজীবন ওকে স্টিকের সাহায্যে হাঁটতে হবে।আরও একমাস হাসপাতালে থেকে ফিরে তাতানের কথা বলাই কম হয়ে যায়।ও বুঝতে পারে, যে জীবনে আর কখনও ক্রিকেট ব্যাট হাতে ধরা যাবে না।স্বপ্ন ও বাস্তব অর্থহীন হয়ে যায় ওর কাছে।এর ঠিক তিনমাসের মাথায় এক অসমাপ্ত রাতে সিলিং ফ্যানে দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়ে তাতান।
বাঘাযতীনের এই ফ্ল্যাটে মৃনালরা অনেক দিনের বাসিন্দা।তাতানের যখন চার বছর তখন থেকেই এখানে বসবাস।যাদবপুর বিদ্যাপীঠে তাতানকে পৌঁছে একটু হেঁটে সেলিমপুর ব্রিজের নীচে মৃনাল ও তার বন্ধুরা বুধুয়ার চায়ের দোকানে মর্নিং ওয়াক সেরে জমা হত।ছাপড়া থেকে সেই কিশোর বয়সে বুধুয়া তার দেশোয়ালি চাচার সাথে এই শহরে এসেছিল ভাগ্য অন্বেষণে।নানান জায়গা ,নানা রুজির পথ পেরিয়ে শেষে এই চায়ের দোকান খোলে বুধুয়ার চাচা।বুধুয়া দেখতে দেখতে মৃনালদের সামনেই যুবক হল।বিয়ে করল।এখন সে দুই সন্তানের পিতা।একটি দশ বছরের মেয়ে ও একটি দুবছরের ছেলে।বেশ ভালো চলে বুধুয়ার দোকান।চা,ডিমটোস্ট এর পাশাপাশি সিগারেট, গুটখা,চিপস,টুকটাক স্টেশনারি জিনিস সবই তার ছোট্ট দোকানে ঠাঁই পেয়েছে।বিকেলে চাএর সাথে হাতরুটি,তড়কা,ডিমকষা,ঘুঘনিও বিক্রি করে।মৃনালরা টানা তের -চোদ্দ বছর এই দোকানে আড্ডা দেয়।আগে সকালে দিত।এখন বিকেলে বসে।বুধুয়ার বৌ পদ্মা ,বুধুয়াকে দোকানের কাজে সাহায্য করে। ছেলে,মেয়ে দুটোও বিকেলে দোকানেই থাকে।মৃনালদের সাথে ওদের সম্পর্কটাও বেশ সহজ।তাতান চলে যাবার পর ছমাস পর বুধুয়ার ছেলেটা হল।মৃনালের একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয় বাচ্চাটাকে দেখলে।মৃনাল ওকে তোজো বলে ডাকে।ওর দেওয়া নামটাই রয়ে যায়।
তোজোর খুব জ্বর।পিজিতে ভর্তি।পদ্মা ছেলের সাথেই আছে।সাতদিন হল।একটু ভালোর দিকে তোজো। বুধুয়া হাসপাতালের দিকে রওয়ানা দেয়।আজ ছুটি দেবে তোজোকে।হাসপাতালের সামনের রাস্তাটা পার হতে যাবে বুধুয়া এমন সময় একটা বাস হাজরার দিকে দূ্রন্ত গতিতে ছুটে যায়।পিষে দিয়ে যায় বুধূয়াকে।তোজোকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে একাকী পদ্মা,কিন্তু জীবন্মৃত।জীবনের গতি থেমে যায় সহসাই।অবস্থা চরমে ওঠেকিছুদিন পর, যখন পদ্মা ব্রেইন স্ট্রোক এ আক্রান্ত হয়।দুটো ছেলে মেয়ে অথই জলে পড়ে।বুধুয়ার ভাই ,ভাইয়ের বৌ আসে পরিস্থিতি সামাল দিতে।চায়ের দোকান বন্ধ।পদ্মার চিকিৎসা সামাল দিতে নাজেহাল অবস্থা।মৃনাল ও তার বন্ধুরা এই সময় খুব সাহায্য করে।পাড়ার ক্লাব থেকে চাঁদা তুলে কোনরকমে চলছিল।বুধুয়ার মেয়ে পূজা ইস্কুল বন্ধ করে ছোট ভাই ,মায়ের দেখাশুনা করতে লাগল। পদ্মা বেচেঁ ছিল ছমাস।
মৃনাল আজ নতুন উদ্যমে ঘর সাজাচ্ছে। ভাবছে,ঈশ্বর বুঝি তাদের আবার জড়ভরত জীবন থেকে মুক্তি দিতে চলেছেন।অন্তরা কিছুই বুঝতে পারছে না মৃনালের এই উৎসাহ ,উদ্দীপনা কেন।অন্তরাকে মৃনাল জোর করে রান্নাঘরে ঢুকিয়েছে।সামনে দাঁড়িয়ে রান্না করিয়েছে।”পুষ্প,বৌদিকে দেখো,আমি একঘন্টার মধ্যে আসব” বলে বেরিয়ে গেল মৃনাল।
ঠিক একঘন্টা পড়ে পূজা আর তোজোকে নিয়ে ঘরে ঢোকে মৃনাল।তোজোকে অন্তরার কোলে দিয়ে বলে, ” অন্তরা এই নাও তোমার তাতান।ও ফিরে এসেছে দেখ।”
আজ তোজোর পাঁচ বছরের জন্মদিন।অন্তরা নিজে হাতে সব রান্না করেছে। পূজা এবার সেভেনে উঠবে।সামনের মাসেই ফাইনাল।সেও খুব ব্যস্ত ভাইকে নিয়ে।যদিও মামনি খালি পড়তে বলছে।আজকের দিনটা পূজা অন্তরাকে বলে ম্যানেজ করেছে। বলেছে,”মামনি, কাল দশ ঘন্টা পড়ব।আজ একটু মজা করতে দাও।” অন্তরা ছদ্মপ্রশ্রয়ে মৃদু বকুনি লাগায়। বিকেলে অতিথিরা আসবেন। অন্তরার ছোটাছুটির অন্ত নেই।
মৃনাল পূজা ও তোজোকে দত্তক নিয়েছিল।বুধুয়ার ভাই সানন্দে রাজি হয়ে গিয়েছিল এই প্রস্তাবে।অন্তরাকে বাঁচাতে এবং নিজেদের ভাঙাচোরা জীবনটাকে ঠিক করতে বন্ধুদের পরামর্শ মেনে নিয়েছিল মৃনাল।বাচ্চা দুটিও সঠিক আস্তানা খুঁজে পেয়েছিল।
একফাঁকে মৃনাল ডাকে অন্তরাকে।
“ছেলে,মেয়ের জন্য তো আমাকে ভুলেই গেছ।ওদের জন্য নতুন এত জামাকাপড় কিনলে। নিজের জন্য কিছু কিনেছ?” মৃনাল অন্তরার হাতে একটা প্যাকেট তুলে দেয়।
“এটা কি”? অন্তরা অবাক হয়।কপালে লেগে থাকা সুখ বিন্দু গুলো আঁচলে মেখে রাখে।
প্যাকেট থেকে মৃনাল নীল জামদানিটা বার করে অন্তরাকে জড়িয়ে দেয়।
“এটা আজ পরবে। এই রঙটা তোমায় খুব মানায়।”
অন্তরা মৃনালের হাতটা আকড়েঁ ধরে।খুশি ছড়িয়ে পড়ে বাঘাযতীনের তিন কামরার ফ্ল্যাটে।
খুব সুন্দর গল্প পড়ে ভালো লাগলো